পিতৃপক্ষ: পূর্বপুরুষ স্মরণের এক পবিত্র পর্ব
হিন্দু জীবনে পিতৃপক্ষ এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ সময়। ভাদ্রপদ মাসের কৃষ্ণপক্ষ জুড়ে চলা ষোলো দিনের এই পর্ব শুরু হয় অমাবস্যা থেকে এবং শেষ হয় মহালয়ার দিনে। এটি মূলত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত, যেখানে তাঁদের স্মরণ, তর্পণ ও শ্রাদ্ধের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। হিন্দুধর্মে এই সময়টিকে পিতৃঋণ পরিশোধের পথ হিসেবে দেখা হয়, কারণ বিশ্বাস করা হয়—মানুষ জন্মসূত্রেই তিন ঋণের ভার বহন করে: ঋষি ঋণ, দেবঋণ ও পিতৃঋণ। এর মধ্যে পিতৃঋণ পূর্ণ হয় পূর্বপুরুষদের স্মরণ, সন্তানলালন-পালন ও শ্রাদ্ধকর্মের মাধ্যমে।
পিতৃপক্ষের উৎপত্তির শিকড় পাওয়া যায় বেদে, যেখানে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানানো স্তোত্র রয়েছে। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে:
ঋগ্বেদ (১০.১৫.১) — পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদ
उदु त्ये ता नः पितरः सुपर्णा ये अग्निदग्धा ये अनग्निदग्धाः। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়-ঝরনা আর লোকসংস্কৃতির মেলবন্ধন
तेषां वयं सुश्रवसः स्याम पितॄणां मातरः सुवर्चाः॥
“যেসব পূর্বপুরুষ, সেই পিতৃগণ, জ্যোতির্ময় পাখির মতো, কেউ দাহসংস্কারিত, কেউ অদাহিত—তাঁরা আমাদের আশীর্বাদ করুন; তাঁরা যেন আমাদের গৌরব দান করেন। । আমরা যেন তাঁদের বংশধর হিসেবে তাঁদের খ্যাতি, মহিমার ও ঐশ্বর্যের যোগ্য হই।”
ঋগ্বেদ (১০.১৪.১–২) — পিতৃদের আহ্বান
यान्ति देवा अनु देवयन्तो यान्ति धीराः पितृभिः सुपर्णाः। গীতা এবং...
यान्ति यज्ञं पश्यन्तो अद्रुहन्तो देवा देवानामपि याति पन्थाः॥
“দেবতারা যজ্ঞের পথে অগ্রসর হন, জ্ঞানীরা পিতৃগণের সাথে পক্ষীর মতো উর্ধ্বগমন করেন। তারা যজ্ঞে অংশ নেন, নিষ্কলুষ দৃষ্টিতে তাকে অবলোকন করেন; এই পথই দেবতাদের ও পূর্বপুরুষদের দ্বারা অগ্রসর হওয়া পবিত্র পথ।”
এই মন্ত্র কেবল প্রার্থনা নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক সেতুবন্ধন—যেখানে জীবিত প্রজন্ম পূর্বপুরুষদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়।
আমরা এই সময় তর্পন করি, জলের সঙ্গে কালো তিল ও চাল অর্পণ করে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে নিবেদন জানাই । শ্রাদ্ধের সময় সাধারণত সাত্ত্বিক আহার যেমন খিচুড়ি, ক্ষীর, মৌসুমি সবজি প্রভৃতি রান্না করা হয়। এগুলো প্রথমে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়, পরে ব্রাহ্মণ, দরিদ্র এবং কাক পক্ষী কে দেওয়া হয়—যাদের পিতৃলোকের দূত বলে বিশ্বাস করা হয়।
গরুড় পুরাণ (প্রেতখণ্ড ১০.৭–৮) এ বলা হয়েছে:
पिण्डोदकक्रियाहीनाः पितरः स्युः क्षुधार्दिताः। প্রাচীন ঐতিহ্য - দেউলঘাটার কালো দুর্গার মন্দির
तस्मात्पिण्डं च तोयं च श्राद्धे दत्त्वा प्रसीदति॥
“যে পূর্বপুরুষরা খাদ্য ও জলের নিবেদন পান না, তাঁরা ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কষ্ট পান। তাই পিণ্ড ও জল শ্রাদ্ধে প্রদান করলে তাঁরা সন্তুষ্ট হন।”
এই শ্লোক নির্দেশ করে যে, পিতৃঋণ পূরণের জন্য মানবজীবনে নির্দিষ্ট কর্ম ও নিবেদন অপরিহার্য। মহালয়ার ভোরে গঙ্গার ঘাটে অসংখ্য ভক্ত এই তর্পণ সম্পন্ন করেন।
পিতৃপক্ষ নিয়ে মহাভারতে কর্ণের কাহিনি বিশেষভাবে আলোচিত। মৃত্যুর পর পরলোকে তিনি দেখলেন, অঢেল ধনসম্পদ দান করার পরও খাদ্য না দেওয়ায় তিনি আহার পাচ্ছেন না। বিষ্ণুর করুণায় তিনি পৃথিবীতে ফিরে এসে শ্রাদ্ধ সম্পাদন করেন এবং খাদ্য দানের প্রথা প্রবর্তিত হয়। এই কাহিনি শ্রাদ্ধের মূল মর্মকে স্পষ্ট করে—খাদ্য অর্পণ শুধু আচার নয়, বরং আত্মিক তৃপ্তির পথ।
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পিতৃপক্ষ ভিন্ন ভিন্নভাবে পালিত হয়। উত্তর ভারতে গয়ার বিষ্ণুপদ মন্দিরে লক্ষ মানুষ পিণ্ডদান করে, কারণ বিশ্বাস করা হয় এখানে অর্পণ করলে পূর্বপুরুষরা মুক্তিলাভ করেন। বাংলায় পিতৃপক্ষ দুর্গাপূজার আগমনী সময়ের সঙ্গে পরিণতি পায়।, তাই মহালয়ার সকালে গঙ্গার ঘাটে অসংখ্য পরিবার তর্পণ করে, পূর্বপুরুষ স্মরণের পাশাপাশি দেবীর আগমনেরও সূচনা হয়। মহারাষ্ট্র ও গুজরাটে স্থানীয় খাদ্য যেমন পুরণ পোলি নিবেদন করা হয়, আর দক্ষিণ ভারতে অন্নদান বা ভোজন দানের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
উপনিষদগুলিও পিতৃঋণ বিষয়ে আলোকপাত করেছে। তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে:
তৈত্তিরীয় উপনিষদ (৩.৭) — পিতৃঋণ
ऋषिभ्यो देवार्षेभ्यः पितृभ्यः। বিয়েতে বারবার বাধা ?তার কারণ হতে পারে বাস্তু দোষ
नानृणो गच्छति कश्चन।
पितृभ्यश्च ऋणं प्रजया संप्रत्ययते॥
“ঋষি, দেবতা এবং পিতৃগণের প্রতি মানুষ জন্মসূত্রেই ঋণী। এই ঋণ পূরণ না করে কেউ প্রস্থান করে না। পিতৃঋণ কেবল সন্তানধারণ ও বংশরক্ষা দ্বারা পূর্ণ হয়।”
আবার ছান্দোগ্য উপনিষদে উল্লেখ আছে যে, পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা অর্পণ অর্থাৎ শ্রাদ্ধ কার্য সম্পন্ন করলে তাঁদের আশীর্বাদে উত্তরসূরি সমৃদ্ধ হয়।
ছান্দোগ্য উপনিষদ (৫.১০.১৬) — অন্ন ও পূর্বপুরুষ
य एवमेतद्विद्वान्पितृलोके महियते। কামরূপ কামাখ্যার বিশ্ব ইতিহাস
यावदेव विद्यासंपन्नः स्यात्तावदेव पितॄणामनुगृह्णाति॥
“যিনি এই জ্ঞান অবলম্বন করেন তিনি পিতৃলোকে সমৃদ্ধ হন। যতদিন তিনি বিদ্যাসম্পন্ন ও আচারানুষ্ঠানে নিয়োজিত থাকেন, ততদিন তিনি পূর্বপুরুষদের পোষণ ও আশীর্বাদ দান করেন।”
এইভাবে দেখা যায়, পিতৃপক্ষ কেবল আচার পালনের সময় নয়, বরং প্রজন্মের মধ্যে সেতুবন্ধনের এক বার্ষিক অনুষঙ্গ। এটি জীবিতদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা আমাদের পূর্বসূরিদের ধারাবাহিকতার অংশ এবং তাঁদের অবদান ও ত্যাগের জন্য কৃতজ্ঞতা জানানো আমাদের কর্তব্য। তর্পণ ও শ্রাদ্ধের মাধ্যমে যে নিবেদন করা হয় তা কেবল প্রতীকী নয়, বরং মহাজাগতিক ভারসাম্য রক্ষারও এক উপায়। এ কারণেই মহাভারত ঘোষণা করে: “শ্রাদ্ধের দ্বারা পূর্বপুরুষ তুষ্ট হন, দেবতারা তাঁদের অংশে তুষ্ট হন, ঋষিরা ঘৃত নিবেদনে তুষ্ট হন। তাই জ্ঞানীরা শ্রাদ্ধকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন।”
পিতৃপক্ষ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—পূর্বপুরুষদের প্রতি কৃতজ্ঞতা শুধু স্মৃতির বিষয় নয়, বরং নিত্যজীবনের এক নৈতিক কর্তব্য।
সামাজিক ঋণ ও হিন্দুধর্মের ঋণত্রয় কঠিন পরিশ্রমের পরেও জীবনের সাফল্য পেতে ভাগ্য সাথ দিচ্ছে না ?
আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো “Social Debt” বা সামাজিক ঋণ। এর অর্থ কেবল আর্থিক ঋণ নয়, বরং জীবনের সমস্ত সম্পর্ক ও পারস্পরিক নির্ভরতার মাধ্যমে গড়ে ওঠা অদৃশ্য দায়বদ্ধতা। আমরা জন্ম থেকে পরিবার, সমাজ, প্রকৃতি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরতার কারণে আমরা সকলের কাছে ঋণী—যা ব্যক্তিগত জীবন ও সামষ্টিক কল্যাণ উভয়কেই প্রভাবিত করে। একে বলা হয় ecological debt (প্রকৃতির কাছে ঋণ), life debt (অন্যের যত্ন ও সেবার কাছে ঋণ), এবং সামাজিক দায়িত্বের নানান রূপ।
ভারতের ঋষিরা হাজার বছর আগে এই সত্য অনুধাবন করেছিলেন। তাঁরা মানবজীবনের গভীরতা উপলব্ধি করে কিছু মৌলিক কর্তব্য নির্ধারণ করেন। এই কর্তব্যগুলিকে বলা হয় ঋণ বা দায় ও কর্তব্য, এবং এগুলি পূর্ণ হয় যজ্ঞ বা পবিত্র কর্মের মাধ্যমে। যজ্ঞ মানে কেবল অগ্নিহোম নয়, বরং শিক্ষা, সেবা, দান, প্রকৃতি সংরক্ষণ ইত্যাদি সমস্ত সামাজিক ও আধ্যাত্মিক কর্তব্য।
লক্ষ লক্ষ পূর্বপুরুষ আমাদের ভূমি, সংস্কৃতি ও দেশ রক্ষার জন্য তাদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। আজও সৈনিক ও আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা আমাদের সুরক্ষার জন্য জীবন বাজি রেখে চলেছেন। আমরা কি তাঁদের কাছে অনেক ঋণী নই গ্রহণে নিষিদ্ধ অন্ন গ্রহন! নেপথ্যে রয়েছে পৌরাণিক বনাম বৈজ্ঞানিক কারণ
ঋণত্রয়: মানুষের জন্মগত তিন ঋণ: দায় ও কর্তব্য, ও পঞ্চমহাযজ্ঞের প্রাসঙ্গিকতা: সামাজিক ঋণ পরিশোধের পথ
ঋগ্বেদ ও তৈত্তিরীয় সংহিতাতে উল্লেখ আছে যে, মানুষ জন্মসূত্রে তিন ঋণ নিয়ে জন্মায়—যাকে বলে ঋণত্রয় ।
শতপথ ব্রাহ্মণ (১১.১.১) উল্লেখ করেছে যে এই ঋণগুলি মানবজীবনের অঙ্গ, যা সমাজ ও প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে।
এই পাঁচ ঋণের সঙ্গে যুক্ত হলো পঞ্চমহাযজ্ঞ, যা হিন্দু ধর্মে প্রতিদিনের কর্তব্য হিসেবে ধরা হয়েছে। এগুলি হলো—
ঋষি ঋণ এবং ব্রহ্মযজ্ঞ সন্ধ্যার পর ভুলেও এই কাজগুলো কখনোই করবেন না
কর্তব্য: ঋষি ও শিক্ষকগণের কাছে ঋণ শোধ করা।
কার্য: স্বাধ্যায় (শাস্ত্র অধ্যয়ন), জ্ঞান চর্চা, তপস্যা (আত্মসংযম), ঋষি ও শিক্ষকের সম্মান, প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠান রক্ষা।
দেবঋণ এবং দেবযজ্ঞ "সাবর্ণ রায় চৌধুরী বাড়ির ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজো"
কর্তব্য: দেবতা ও প্রকৃতির কাছে ঋণ শোধ করা।
কার্য: যজ্ঞ, প্রাকৃতিক শক্তির সংরক্ষণ ও সঠিক ব্যবহার, প্রার্থনা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। দেবতা ও প্রকৃতির প্রতি দায় প্রকৃতির সংরক্ষণ ।
পিতৃঋণ এবং পিতৃযজ্ঞ
কর্তব্য: পিতামাতা ও পূর্বপুরুষদের প্রতি দায় পূর্ণ করা। ৩৫০ বছর পুরনো দুর্গোৎসব : কমলা দেবী
কার্য: শ্রাদ্ধ, তর্পণ, সন্তান প্রতিপালন, পারিবারিক দায়িত্ব পালন।
শতপথ ব্রাহ্মণ আরও দুটি ঋণ উল্লেখ করেছে, যা সমাজকে আরও বিস্তৃত দায়িত্বের দিকে নিয়ে যায়।
নৃঋণ এবং মনুষ্যযজ্ঞ
কর্তব্য: সমগ্র মানব সমাজের প্রতি সহমর্মিতা ও দায়িত্ব।
কার্য: অতিথিসেবা, অভাবীদের সাহায্য, প্রতিবেশীর সাহায্য।, মানবকল্যাণ।
ভূতঋণ এবং ভূতযজ্ঞ
কর্তব্য: প্রকৃতি, উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংরক্ষণ।
কার্য: উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির প্রতি সহমর্মিতা, সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপণ, পরিবেশ রক্ষা: ভূমি, জল এবং বাতাসের দূষণ রোধ |
ঋণ ও রাষ্ট্র ধারণার সম্পর্ক
একটি আকর্ষণীয় প্রস্তাবিত তত্ত্ব হলো, রাষ্ট্র শব্দটি সম্ভবত রা-ত্র বা ঋণত্র থেকে উদ্ভূত—অর্থাৎ নাগরিকদের একটি সমষ্টি, যেখানে প্রত্যেকে এই ঋণগুলি পালনের জন্য বাধ্য। রাষ্ট্র মানে শুধু প্রশাসনিক কাঠামো নয়, বরং সামাজিক-আধ্যাত্মিক দায়বদ্ধতার ঐক্য।
“সামাজিক ঋণ” আধুনিক সমাজতত্ত্বে যেমন পারস্পরিক নির্ভরতার প্রতীক, তেমনি হিন্দু দর্শনের ঋণত্রয় ও পঞ্চমহাযজ্ঞ মানুষের জীবনে কর্তব্য ও সামঞ্জস্যের ভিত্তি। এর মাধ্যমে মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সমাজ ও প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে, এবং মানবসভ্যতার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে।
মহালয়া: শাস্ত্রীয় ভিত্তিতে পিতৃপক্ষের সমাপ্তি ও দেবীপক্ষের সূচনা
পিতৃপক্ষের সমাপ্তি ও পিতৃঋণ
মহালয়া হিন্দু পঞ্জিকার ভাদ্রপদ মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা। এই দিনে পিতৃপক্ষ শেষ হয় এবং পিতৃঋণ পরিশোধের চূড়ান্ত কার্যক্রম—মহাতর্পণ সম্পন্ন হয়।
অথর্ববেদ (১৮.৩.৫১) — তর্পণ সম্পর্কিত
आपो अस्मान मातरः शुन्धयन्तु घृतं दुहानाः पयो अस्मान अवन्तु।
पितृभ्यः शुद्धं हविरस्तु नाम्नेऽनुमतेष्टं हविषा वि वोढुम्॥
“আমাদের মাতৃস্বরূপা জল যেন আমাদের পরিশুদ্ধ করে, তারা যেন ঘৃত ও দুধ দান করে আমাদের রক্ষা করে। এই নির্মল হবি (অর্ঘ্য) পিতৃগণের উদ্দেশ্যে হোক; হে অনুমতি দেবী, তুমি যেন এই নিবেদন তাঁদের নিকট পৌঁছে দাও।”
তৈত্তিরীয় উপনিষদ (৩.৭)-এ বলা হয়েছে:
ऋषिभ्यो देवार्षेभ्यः पितृभ्यः।
नानृणो गच्छति कश्चन।
पितृभ्यश्च ऋणं प्रजया संप्रत्ययते॥
অর্থাৎ, “ঋষি, দেবতা ও পিতৃদের প্রতি মানুষ জন্মসূত্রে ঋণী। এই ঋণ সন্তানের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হয়।” মহালয়ার তর্পণ এই জন্মগত ঋণ পরিশোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
মহাভারত (অনুশাসন পর্ব, ৯১.১২) — শ্রাদ্ধের মাহাত্ম্য:
श्राद्धेन पितरः तृप्ता देवा भागेन तृप्यति।
ऋषयश्च हविर्भागैस्तस्मात् श्राद्धं प्रचक्षते॥
“শ্রাদ্ধ দ্বারা পিতৃগণ তৃপ্ত হন, দেবতারা তাঁদের অংশে তুষ্ট হন এবং ঋষিরা হবি দ্বারা সন্তুষ্ট হন। তাই জ্ঞানীরা শ্রাদ্ধকে পবিত্র ও অপরিহার্য আচার বলে ঘোষণা করেছেন।”
দেবীপক্ষের সূচনা ও চণ্ডীপাঠ
মহালয়ার দিনই দেবীপক্ষের সূচনা। মার্কণ্ডেয় পুরাণ (দেবী মহাত্ম্য)-এ বর্ণিত:
यत्र हि देवी चरति भगवती महिषासुरसंहारे।
तत्रैव रक्षां धर्मस्य सम्यक् स्थापयति॥
অর্থাৎ, “যেখানে দেবী শুম্ভ-নিশুম্ভ ও মহিষাসুর বধের মাধ্যমে অবস্থান করেন, সেখানে ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটে।”
এই আধ্যাত্মিক মুহূর্ত বাংলায় চণ্ডীপাঠ ও দেবীর আহ্বান আচার মাধ্যমে উদযাপিত হয়। চারিদিকে চণ্ডীপাঠের সুর শোনা যায়, যা পিতৃপক্ষের পুন্য স্মরণ থেকে দেবীপক্ষের আনন্দময় আবহে উত্তরণ ঘটায়।
আধ্যাত্মিক তাৎপর্য
মহালয়া শুধু পিতৃঋণ পরিশোধের দিন নয়, বরং দেবীপক্ষের আরম্ভের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জাগরণের দিন। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় জন্মগত এবং সামাজিক ঋণ পালনের গুরুত্ব। যেমন ছান্দোগ্য উপনিষদ (৫.১০.১৬) উল্লেখ করে:
य एवमेतद्विद्वान्पितृलोके महियते।
यावदेव विद्यासंपन्नः स्यात्तावदेव पितृणामनुगृह्णाति॥
অর্থাৎ, “যে এভাবে জ্ঞান সম্পন্ন, সে পিতৃলোকে সমৃদ্ধ হয় এবং পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়।”
বাংলায় মহালয়ার ভোরে গঙ্গার ঘাট, পাড়ের মণ্ডপ এবং চণ্ডীপাঠের সুর মিলিয়ে এক অনন্য আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পিতৃপক্ষের গম্ভীরতা থেকে দেবীপক্ষের আনন্দময়তা—এই দ্বৈত রূপ বাংলার আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
*******************************************************************************
মহালয়ার তাৎপর্য ও শাস্ত্রীয় ভিত্তিতে পিতৃপক্ষ - দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষণ ব্যাখ্যা
- কাঞ্চন বন্দ্যোপাধ্যায়