বলিউড ও টলিউডে নারীকেন্দ্রিক সিনেমার উত্থান কেবল বিনোদনের জগতে নয়, সমাজে নারীর অবস্থান ও অধিকার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই পরিবর্তনগুলি ভবিষ্যতে আরও সমতা সমাজ গঠনে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে নারীকেন্দ্রিক সিনেমার অবস্থান অনেক আগেই শুরু হয়েছে। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনদের সিনেমায় নারী বরাবরই প্রধান চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।
"দেবী" (১৯৬০) – সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এই সিনেমায় শর্মিলা ঠাকুর এক কিশোরীর ভূমিকায় যিনি সমাজের অন্ধ বিশ্বাসে 'দেবী'রূপে পূজিতা হন। চারুলতা" (১৯৬৪) – সত্যজিৎ রায়ের মাস্টারপিস ‘চারুলতা’ শুধু নারীকেন্দ্রিক নয়, এক নারীর একাকীত্ব, মনের আকাঙ্ক্ষা এবং আত্ম-অন্বেষণের এক অসাধারণ দলিল। মাধবীলতার চরিত্রে মাধুরী দেবীর অভিনয় আজও সিনেমার ইতিহাসে উজ্জ্বল। নারীর উপরে চাপিয়ে দেওয়া দেবীত্ব এবং তার মধ্যেকার দুঃখ ও অসহায়তার চিত্র রীতিমতো আলোড়ন ফেলে। "মেমসাহেব" (১৯৭২) – উত্তম কুমার ও আপর্ণা সেন অভিনীত এই ছবিতে এক শিক্ষিতা, স্বাধীনচেতা নারীর মনস্তত্ত্বকে ফুটিয়ে তোলা হয়। নারীর নিজস্ব পরিচয় খোঁজার লড়াই এখানে উঠে এসেছে সুন্দরভাবে। "স্ত্রী" (১৯৭২) – তুলসীদাসের ‘শকুন্তলা’ অবলম্বনে নির্মিত এই ছবি নারীর ক্ষমতায়ন ও আত্মসম্মানের প্রতীক হয়ে ওঠে। অরুন্ধতী দেবীর সাবলীল অভিনয় ছবিটিকে অমর করে তোলে। "মৌচাক" (১৯৭৫) – যদিও এটি একটি কমেডি ছবি, তবে রানু (মহুয়া রায়চৌধুরী) চরিত্রটি ছিল সাহসী ও প্রতিবাদী। সে সময়ের তুলনায় নারী চরিত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক দৃষ্টান্ত ছিল এই ছবি।"পারমিতার একদিন" (২০০০) – অপর্ণা সেন পরিচালিত এই ছবি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে নারীর মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের গল্প বলে। রাহুল বোস ও রূপা গাঙ্গুলির সংলাপহীন অভিব্যক্তি দর্শকদের মন ছুঁয়ে যায়। "চোখের বালি" (২০০৩) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমায় ঐশ্বর্য রাই অভিনীত ‘বিনোদিনী’ চরিত্রটি এক বিধবার অভিমান, আকাঙ্ক্ষা ও আত্মসম্মানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। রীতিমতো বক্স অফিসে সফল এই ছবি প্রমাণ করেছিল, নারীকেন্দ্রিক সিনেমাও জনপ্রিয় হতে পারে।
বর্তমান সময়ের কিছু প্রভাবশালী নারী-কেন্দ্রিক ছবিঃ "মুক্তধারা" (২০১২)শিবু-নন্দিতা জুটির অন্যতম সফল ছবি যেখানে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের চরিত্র ছিল দৃঢ়চেতা ও প্রভাবশালী। ছবিটি সমাজ পরিবর্তনের বার্তা দেয় এবং একটি সফল নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র হিসেবে উঠে আসে। "বেলা শেষে" (২০১৫) – সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত অভিনীত এই চলচ্চিত্রে দেখা যায় বয়ঃপ্রাপ্ত এক দম্পতির জীবনে নারীর নিজস্ব স্বর প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। "রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত" (২০১৯) – সরলা-রাজলক্ষ্মীর চরিত্রে জয়া আহসানের আবেগপ্রবণ অভিনয়, স্বাধীনচেতা মনোভাব এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে এক শক্তিশালী বার্তা বহন করে। "বিবাহ অভিযান" (২০১৯) যদিও এটি এক বাণিজ্যিক কমেডি, তবুও ছবির কেন্দ্রে ছিলেন সোয়েতা বসু প্রসাদ, যিনি নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়েতে রাজি না হওয়ার সাহসিকতা দেখান। "ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি" (২০২০) ঋতাভরী চক্রবর্তী অভিনীত এই ছবিতে একজন নারী পুরোহিতের লড়াই তুলে ধরা হয়। সমাজে নারীর ধর্মীয় ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এই সিনেমা। বেলাশুরু" (২০২২) শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায় পরিচালিত এই ছবিতে বর্ষীয়ান অভিনেত্রী স্বাতিলেখা সেনগুপ্ত অসাধারণ অভিনয়ে মাত করেন। বৃদ্ধ দম্পতির সম্পর্কে নারীর আত্মমর্যাদার প্রশ্ন উঠে আসে এখানে। ছবিটি ১০০ দিনের বেশি চলেছিল এবং প্রায় ১০ কোটি টাকার বেশি আয় করেছিল। আধুনিক নারীর আত্মসচেতনতা ফুটে উঠেছে তাঁর চরিত্রে। বলিউড দীর্ঘদিন ধরে হিরো-কেন্দ্রিক সিনেমা বানিয়ে এসেছে। তবে ২০০০-এর পরের সময়ে বলিউডে বড় পরিবর্তন এসেছে। নারীকেন্দ্রিক গল্প নিয়ে বানানো সিনেমা বক্স অফিসে সফল হচ্ছে।
বর্ষাকালে ত্বক ও চুলের যত্ন: বৃষ্টির আদরে সুস্থ সৌন্দর্য ধরে রাখার কিছু টিপস
কুইন" (২০১৪) – কঙ্গনা রানাওয়াত অভিনীত এই ছবিতে রানি নামের এক সাধারণ মেয়ের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার কাহিনি দেখানো হয়েছে। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর নিজের হানিমুনে একা যাওয়া মেয়ের সাহসী পদক্ষেপে মুগ্ধ হয়েছে দর্শকরা। ১০ কোটি টাকার বাজেটে তৈরি এই ছবি প্রায় ৯৭ কোটি টাকা আয় করেছিল।"পিঙ্ক" (২০১৬) – তাপসী পান্নু ও অমিতাভ বচ্চনের এই ছবিতে নারীর সম্মতি ও ব্যক্তিগত পরিসরের গুরুত্ব নিয়ে সোচ্চার হয়েছে বলিউড। 'না' মানেই 'না'—এই ডায়লগ আজ সামাজিক আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছে। "রাজি" (২০১৮) – আলিয়া ভাট অভিনীত ভারতীয় গুপ্তচরের গল্প 'রাজি' বক্স অফিসে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আয় করে। দেশপ্রেম, নারীর বুদ্ধিমত্তা আর আবেগের মিশেলে নির্মিত এই ছবিটি ছিল এক অনন্য উদাহরণ। "ছপাক" (২০২০) – অ্যাসিড আক্রান্ত এক নারীর সংগ্রামের কাহিনি নিয়ে নির্মিত দীপিকা পাড়ুকোনের এই ছবি সমাজের চোখে এক বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। "মিমি" (২০২১) – কৃতি স্যানন অভিনীত সারোগেসির মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে তৈরি এই সিনেমা প্রমাণ করেছে, নারীকেন্দ্রিক ছবিও হতে পারে একইসাথে হৃদয়স্পর্শী ও বিনোদনমূলক। "গঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি" (২০২২) – সঞ্জয় লীলা বনশালির পরিচালনায় আলিয়া ভাট এখানে এক দেহব্যবসায়ী মহিলার মানবাধিকার রক্ষার লড়াইকে প্রাণবন্ত করে তোলেন। ছবিটি আয় করেছিল প্রায় ১৫০ কোটি টাকা।