উচ্চতায় ও ওজনে উটপাখির পরে থাকলেও, হিংস্রতার দিক থেকে পাখিদের মধ্যে ক্যাসোয়ারি দখল করেছে প্রথম স্থান। পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক পাখি হিসেবে পরিচিত এই ক্যাসোয়ারি উত্তরপূর্ব অস্ট্রেলিয়ার উষ্ণমণ্ডলীয় জঙ্গল, নিউগিনি এবং সংলগ্ন কিছু দ্বীপের স্যাঁতস্যাঁতে রেনফরেস্টে দেখা যায়। তারা সাধারণত দুর্গম অরণ্যের গভীরে বাস করে, যা তাদের জীবনযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
প্রসঙ্গত, ক্যাসোয়ারির আকার ও গঠন অত্যন্ত শক্তিশালী। এই পাখির উচ্চতা প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট এবং ওজন ষাট কেজি পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত, স্ত্রী ক্যাসোয়ারি পুরুষের চেয়ে আকারে বড় হয় এবং তাদের পালকের রঙও বেশি উজ্জ্বল হয়। ক্যাসোয়ারির ডানা অতি কমজোরি, যা তাদের আকাশে উড়তে সক্ষম করে না। তাদের শরীর কালো পালকে ঢাকা, তবে গলার পালক মায়াবী নীল এবং গলা থেকে ঝুলে থাকে গোলাপী চামড়ার ঝালর। মাথার ওপর ৭ ইঞ্চি লম্বা, চ্যাপ্টা এবং শক্ত একটি ঝুঁটি থাকে, যা কেরাটিন নামক প্রোটিন দিয়ে তৈরি। তাদের ঠোঁট তীক্ষ্ণ এবং চোখের দৃষ্টি ভয়াবহ। ক্যাসোয়ারি এমন একটি পাখি, যা লাজুক হলেও, ভয় পেলে তা অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ও হিংস্র হয়ে ওঠে। তাদের তীক্ষ্ণ ঠোঁট ও পায়ের আঙ্গুলের ধারালো নখ দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে আক্রমণ করতে পারে এবং শত্রুকে ভয়ঙ্করভাবে আহত করতে পারে। মাটি থেকে ৬-৭ ফুট উচ্চতায় লাফিয়ে উঠতে সক্ষম ক্যাসোয়ারি, যা আক্রমণের সময় তাদের শক্তি প্রদর্শন করে। এই পাখি অত্যন্ত নিচুস্বরে ডাকে, ফলে তাদের উপস্থিতি সাধারণত আগে থেকে বুঝে ওঠা যায় না। একটি পুরুষ ক্যাসোয়ারি প্রায় ৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিজের দখলে রাখে, এবং সেখানে অন্য পুরুষ ক্যাসোয়ারি ঢুকতে পারেনা। এতে একধরনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সম্ভাবনা থাকে।
উলেখ্য, ক্যাসোয়ারি সাধারণত গ্রীষ্মের শেষ এবং বর্ষার শুরুর দিকে প্রজননকাল শুরু করে। এই সময় পুরুষ ক্যাসোয়ারিরা স্ত্রীকে আকর্ষণ করার জন্য বিশেষ প্রজনন নৃত্য করে। পুরুষের প্রজনন নৃত্যের সময় তার মাথা মাটির কাছাকাছি নিয়ে নাটকীয়ভাবে শরীর কাঁপাতে থাকে এবং মুখ দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ করে। প্রজনন শেষে, স্ত্রী ক্যাসোয়ারি প্রায় ৩ থেকে ৯টি সবুজ ডিম পাড়ে। বাহান্ন দিন পর, ডিম ফুটে শাবক জন্ম নেয়। এই সময়ে পুরুষ ক্যাসোয়ারি কোনও খাওয়া না করে একাগ্রভাবে ডিম পাহারা দেয়। ডিম ফুটে শাবক বের হওয়ার পর, বাবা ক্যাসোয়ারি তাদেরকে মায়ের মতো যত্নে বড় করে। ক্যাসোয়ারির প্রধান খাবার হলো ফল। তারা গাছের ফল খুব পছন্দ করে এবং একবার কোনও গাছে প্রচুর ফল পেলে, সেই গাছের কাছ থেকে অন্য প্রাণীকে যেতে দেয় না। ফল ছাড়াও ক্যাসোয়ারি বিভিন্ন ফুল, ছত্রাক, শামুক, পতঙ্গ, ব্যাঙ, পাখি, মাছ, ইঁদুর ইত্যাদি খেতে পছন্দ করে। একটি পূর্ণবয়স্ক ক্যাসোয়ারি দিনে গড়ে প্রায় পাঁচ কেজি ফল খায় এবং পরিপাক না হওয়া ফল তারা আবার খেয়ে নেয়।
এছাড়া, কিছু নিউগিনির আদিবাসীরা ক্যাসোয়ারি পোষে, কারণ তাদের পালকের মূল্য রয়েছে। তারা ক্যাসোয়ারির মাংসও খায়, যদিও মাংসটি সুস্বাদু হলেও অত্যন্ত শক্ত। ক্যাসোয়ারির মাংস রান্নার সময় একটি প্রবাদ রয়েছে: "ক্যাসোয়ারির মাংস রান্না করার সময় পাত্রে একটা পাথর ফেলা উচিত, পাথর গলে গেলে বোঝা যাবে মাংস নরম হয়েছে।"ক্যাসোয়ারি পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক পাখি হিসেবে পরিচিত। এখনও পর্যন্ত ২২১টি আক্রমণের খবর রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৫০টি আক্রমণের লক্ষ্য ছিল মানুষ। এই পাখি প্রতি ঘণ্টায় ৫০ কিমি গতিতে দৌড়াতে পারে এবং তিন কিলোমিটার দৌড়ে গিয়ে আক্রমণ করার নজিরও রয়েছে। তারা জলে সাঁতরে আক্রমণ করারও উদাহরণ রয়েছে। তবে, এখন পর্যন্ত তাদের আক্রমণে দু'টি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে—একটি অস্ট্রেলিয়ায় এবং অপরটি ফ্লরিডায়। সার্বিকভাবে, ক্যাসোয়ারি একটি রহস্যময় ও বিপজ্জনক পাখি, যা তার অসাধারণ শক্তি এবং হিংস্রতার জন্য সারা বিশ্বের পাখিবিশারদের কাছে বিশেষ নজর কাড়ে।