৭ নভেম্বর ২০২৪-এ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর সঙ্গে পুরনো সম্পর্ক পুনর্স্থাপনে মনোনিবেশ করেছেন। ২০ নভেম্বর ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর, ভারত ও আমেরিকার মধ্যে কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে, এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু সন্দেহ এবং সংশয় সৃষ্টি হয়েছে বিশেষ করে শুল্কনীতি এবং বাণিজ্য ঘাটতির প্রেক্ষাপটে।
বিশ্ববাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত-আমেরিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ভারত আমেরিকাকে প্রায় ৭,৫৮০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করলেও, আমেরিকা থেকে ভারত আমদানি করে প্রায় ৪,০১০ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে, দুই দেশের মধ্যে প্রায় ৩,৬৭৪ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে, ট্রাম্পের 'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতি, যা বিদেশি পণ্যের উপর শুল্ক বৃদ্ধি করার মাধ্যমে দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে, ভারতকে উদ্বেগের মধ্যে ফেলেছে। বিশেষত, ট্রাম্প তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে ভারতীয় পণ্যের উপর শুল্ক বৃদ্ধি করার জন্য হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ২০১৯ সালে, ট্রাম্প সরকার ভারতীয় পণ্যের উপর আমেরিকায় শুল্ক বৃদ্ধি করেছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতও আমেরিকার পণ্যের উপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করে। তবে, মোদী সরকার এই পরিস্থিতিতে শুল্ক কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন ১ ফেব্রুয়ারি বাজেটে আমেরিকার বাইক নির্মাতা সংস্থা হার্লে ডেভিডসনের জন্য শুল্ক কমানো হয়েছে।
যা করেছি এবং যা করছি, তা একদিন উদাহরণ হয়ে থাকবে।
উলেখ্য, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একাধিক পদক্ষেপ ভারতীয় অভিবাসীদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। গত ৭ নভেম্বর ট্রাম্পের জয় ঘোষণার পর মোদী তাঁকে অভিনন্দন জানালেও, ট্রাম্পের প্রশাসন ভারতের অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই ১০৪ জন ভারতীয় অভিবাসীকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে, যার মধ্যে ২৫ জন মহিলা এবং ১২ জন নাবালক রয়েছেন। মোদী সরকারের বিদেশ মন্ত্রক এই পদক্ষেপে কোনো মন্তব্য না করার কারণে, অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে, ভারত কি 'বন্ধু' ট্রাম্পকে তুষ্ট করার জন্য এই নিরবতা অবলম্বন করেছে? অতীতে, ট্রাম্পের প্রশাসন ভারতকে শুল্ক বৃদ্ধির জন্য সমালোচনা করেছিল এবং বিশেষ করে ভারতের বাজারে আমেরিকান পণ্যের উপর ১০০ শতাংশ শুল্ক প্রবর্তন করাকে ‘অন্যায়’ হিসেবে দেখিয়েছিল। এর জবাবে ভারতও আমেরিকার ২৮টি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিল। তবে, গত বাজেটে মোদী সরকার এই শুল্ক প্রত্যাহার করেছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের সঙ্গে এই সম্পর্ক পুনরুদ্ধার ও শুল্ক নীতি নিয়ে ভবিষ্যতে আরও জটিলতা আসতে পারে।
প্রসঙ্গত, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) দ্বারস্থ হয়ে এবং আমেরিকার সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে ভারত এই বাণিজ্যিক চাপ মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে পারে। তবে, ভারতের বিরুদ্ধে আমেরিকা যদি একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে তা ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন কর্মসূচির উপর চাপ ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন পরিস্থিতিতে কূটনৈতিকভাবে কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে হবে ভারতকে। বিশ্বে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের জটিলতাকে সামনে রেখে, মোদী সরকার এবং ট্রাম্পের প্রশাসন নতুন কূটনৈতিক সমীকরণ তৈরির চেষ্টা করতে পারে। যদিও ট্রাম্পের শুল্ক নীতি ভারতের জন্য উদ্বেগজনক হতে পারে, তবে একে একটি সুযোগ হিসেবেও দেখা যেতে পারে—বিশেষ করে, ভারতে আমেরিকার প্রভাবিত শিল্পের জন্য আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি এবং ভারতের বাজারে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। মোদী ও ট্রাম্পের সম্পর্ক কূটনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, বাণিজ্য, শুল্ক, এবং অভিবাসন নীতির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে। সময় যতই এগিয়ে যাবে, এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে কীভাবে দুই রাষ্ট্র নেতা একে অপরের সঙ্গে সমঝোতা তৈরি করেন এবং কূটনৈতিকভাবে বিষয়গুলো সামাল দেন।